ad728

ঝিনাইদহে বাল্য বিয়ের ছোবল


FavIcon
নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত : ১৪ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ছবির ক্যাপশন: ad728

ঝিনাইদহে বাল্য বিয়ের ছোবল! স্কুল থেকে সরাসরি শ্বশুরবাড়িতে ২১৩ জন এসএসসি পরীক্ষার্থী। 

মহেশপুরে প্রতিনিধ মিলন হোসেন 
তারা স্বপ্ন দেখেছিল বইয়ের পাতায় জীবনের মানে খোঁজার। কেউ হতে চেয়েছিল শিক্ষক, কেউ পুলিশ, কেউ বা ডাক্তার। কিন্তু পরীক্ষার আগে জীবনের গন্তব্য পালটে গেল—স্কুলের বেঞ্চ ছেড়ে তারা বসলো বিয়ের পিঁড়িতে।

২০২৪ সালের এসএসসি, দাখিল ও ভোকেশনাল পরীক্ষার আগেই ঝিনাইদহ জেলায় ২১৩ জন কিশোরীর বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। জেলা শিক্ষা অফিসের সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে এই ভয়াবহ চিত্র। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনা শুধু সংখ্যার নয়, এটি সমাজের সামগ্রিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

শিক্ষা অফিস জানায়, চলতি বছরে শুধুমাত্র এসএসসি পরীক্ষায় ১৭৪ জন ছাত্রী অনুপস্থিত ছিল—তাদের অধিকাংশই বিয়ের কারণে। দাখিল পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৩৩ জন এবং ভোকেশনালে ৬ জন কিশোরীও একই কারণে পরীক্ষায় বসেনি।

তাদের কেউ কেউ ফরম পূরণ করে রেখেছিল। প্রস্তুতিও নিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ‘মেয়ে বড় হয়ে গেছে’, ‘ভালো পাত্র পাওয়া গেছে’ — এমন নানা সামাজিক চাপে পিতা-মাতা তাদের বিদায় করে দেন সংসারের দায়িত্বে।

প্রশাসনের নজরদারির মধ্যেও কীভাবে এত সংখ্যক বিয়ের আয়োজন সম্ভব হলো—এ প্রশ্নে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা দায় স্বীকার করে নেন। জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মুন্সি ফিরোজা সুলতানা বলেন, “আমরা যতটা পারি নজর রাখি। কিন্তু অনেক সময় গোপনে বা পাশের গ্রামে গিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করে ফেলা হয়। খবরই আমরা পাই না।”

বাল্যবিয়ের অন্যতম কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে জন্মনিবন্ধনে বয়স বাড়িয়ে দেওয়া। জেলা শিক্ষা অফিসের গবেষণা কর্মকর্তা মোছা আফরোজা পারভীন বলেন, “অফিশিয়ালি ১৮ বছরের নিচে বিয়ে বন্ধ থাকলেও জন্মনিবন্ধন কারসাজির কারণে বিয়েকে বৈধ বানানো হচ্ছে। বিয়ের পর প্রশাসন গিয়ে কিছু করতে গেলেও কিশোরীকে ইতোমধ্যে স্বামীর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।”

জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে। তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতও কাজ করছে। তারপরও এমন ঘটনা ঘটছে কেন?

রুরাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের নির্বাহী প্রধান আব্দুর রহমান বলেন, “আমরা বারবার বলছি, বাল্যবিয়ের কারণে শিক্ষাবিচ্যুতি ঘটছে, কিশোরীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু পরিবারগুলো এখনো সচেতন হয়নি। দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, এবং কুসংস্কার এ সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে।”

অনেকে বলছেন, তথ্য পাওয়ার পরেও দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়াই বিয়েগুলোকে বৈধতা দিচ্ছে। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না উঠলে প্রশাসনের একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয় বলেও মনে করেন অনেকে।

২০২৩ সালে ঝিনাইদহে ২৫৭ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের কারণে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এবার সংখ্যাটি কিছুটা কমলেও ২১৩ জন মেয়ের শিক্ষা থেমে যাওয়া কোনোভাবেই স্বস্তিদায়ক নয়।

ঝিনাইদহের এক প্রত্যন্ত গ্রামের কিশোরী রিনা (ছদ্মনাম)। স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবেন। এসএসসি পরীক্ষার জন্য কোচিংও করছিলেন। কিন্তু মার্চের প্রথম সপ্তাহে তার বিয়ে হয়ে যায় পাশের ইউনিয়নের এক প্রবাসীর সাথে। এখন তিনি গৃহবধূ। “লিখতে ভালো লাগত, এখন শুধু রান্না করি,”—ফোনে বলেন রিনা।

রিনার মতো আরও ২১৩ জন মেয়ের গল্প এ বছর থেমে গেছে পরীক্ষার আগেই। সমাজ কি এসব সম্ভাবনার মৃত্যুর দায় নেবে?

আলোচিত শীর্ষ ১০ সংবাদ