বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট: ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও জটিল সমীকরণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
-
প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট: ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও জটিল সমীকরণ
এ এইচ এম ফারুক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যেখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশকে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা আপাতদৃষ্টিতে একটি সমাধানের পথ দেখালেও, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন দাবি ও কৌশল এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিশেষত তারেক রহমানের অনুরোধ, এনসিপি-র শর্ত, এবং জামায়াতসহ অন্যান্য দলের পিআর পদ্ধতির দাবি এই পুরো রাজনৈতিক সমীকরণকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে।
স্বৈরাচার লেডি ফেরাউন: গণতন্ত্রের ৩৬ জুলাই
দেশের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, যখন ৫ আগস্টকে '৩৬ জুলাই' হিসেবে রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রতীকী নামকরণ করা হয়েছে স্বৈরাচারী, লেডি ফেরাউন ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গণতন্ত্র ধ্বংসকারী আগ্রাসী মনোভাবের প্রতিবাদে। তার শাসনামলে দেশের গণতন্ত্রকে যেভাবে পদদলিত করা হয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং মানুষের ভোটাধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। বিগত ২০১৪ সাল থেকে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনই জালিয়াতি ও প্রহসনের এক চরম উদাহরণ।
২০১৪ সালের নির্বাচন: এই নির্বাচনকে অনেকেই 'প্রহসনের নির্বাচন' হিসেবে উল্লেখ করেন। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট এই নির্বাচন বর্জন করায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এটি ছিল বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জনগণের ভোটাধিকারের মৌলিক নীতির ওপর এক বিশাল আঘাত ছিল এটি।
২০১৮ সালের নির্বাচন: এই নির্বাচনটি 'দিনের ভোট রাতে' হওয়ার অভিযোগে ব্যাপকভাবে সমালোচিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও দেশি সংবাদমাধ্যম এই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির প্রমাণ তুলে ধরেছিল। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ ওঠে, যা জনগণের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়।
২০২৪ সালের নির্বাচন: এই নির্বাচন ছিল আরও একটি দৃষ্টান্ত। এটিকে 'আমি আর ডামি'র নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেখানে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল এবং জনগণের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রজনতার জুলাই আন্দোলনের সূত্র ধরে ৫ আগস্ট (যা '৩৬ জুলাই' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে) শেখ হাসিনার শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটি প্রতীকী বার্তা বহন করে। এটি জনগণের সেই আন্দোলনের প্রতিধ্বনি, যা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
যার প্রেক্ষিতে গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তারেক রহমানের অনুরোধ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অঙ্গীকার
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তার এই অনুরোধকে অনেকেই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও প্রত্যাশার প্রতিফলন হিসেবে এই নির্বাচন দ্রুত হওয়া জরুরি, যাতে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। এই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই এবং কেউ যদি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করে, তবে তা জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক হবে। উপদেষ্টাদেরও একই ধরনের মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। এটি জনগণের মধ্যে এক ধরনের আশাবাদ তৈরি করেছে যে, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা হয়তো এবার শেষ হতে চলেছে।
এনসিপি'র শর্ত: নির্বাচন নাকি সংবিধানিক সংস্কার?
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা আসার পরপরই নতুন করে জটিলতা তৈরি করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা কিছু নির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরেছে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হতে দিবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাদের প্রধান দাবিগুলো হলো: সংবিধান সংস্কার, বিচার বিভাগীয় সংস্কার, এবং জুলাই সনদকে সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান। এনসিপি যুক্তি দেখাচ্ছে যে, এসব মৌলিক সংস্কার ছাড়া একটি প্রকৃত অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের এই অবস্থানকে কেউ কেউ দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখলেও, অনেকে এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছেন। সমালোচকদের মতে, এনসিপি মূলত নির্বাচনের জন্য সময়ক্ষেপণ করতে চাইছে, যা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক হতে পারে। এই ধরনের শর্তারোপ প্রধান উপদেষ্টার নির্ধারিত সময়সীমাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই পরিস্থিতিতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ যে, কীভাবে সংস্কারের দাবি এবং নির্বাচনের সময়সীমার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
জামায়াত ও অন্যান্য দলের পিআর পদ্ধতির দাবি: রাজনৈতিক কৌশলের ভিন্নতা
এনসিপি-র পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী এবং কিছু ছোট ছোট দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাচ্ছে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রার্থীরা নির্দিষ্ট আসন থেকে নির্বাচিত না হয়ে বরং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের ওপর ভিত্তি করে সংসদে আসন লাভ করে। জামায়াতের যুক্তি হলো, প্রচলিত 'উইন-টেকস-অল' পদ্ধতিতে ছোট দলগুলো তাদের ভোটের পরিমাণ অনুযায়ী আসন পায় না, এমনকি তাদের ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও। পিআর পদ্ধতি তাদের জন্য ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। এটি একটি দীর্ঘদিনের দাবি, যা এখন নতুন করে সামনে এসেছে।
তবে এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করছে বিএনপি। বিএনপির মতে, পিআর পদ্ধতি জনগণের সরাসরি পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ কেড়ে নেয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। তারা মনে করে, এটি জনগণের ভোটাধিকারের মৌলিক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। বিএনপি প্রচলিত একক প্রার্থীভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থার পক্ষে, যা জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দেয়। জামায়াত ও বিএনপির এই ভিন্নমত দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজনকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। এটি কেবল নির্বাচনী পদ্ধতির বিতর্ক নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস নিয়েও এক গভীর মতবিরোধের প্রতিফলন। এই দুটি প্রধান শিবিরের ভিন্ন অবস্থান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে, যেখানে কোনো একটি পক্ষকে সমর্থন করা হলে অন্য পক্ষ থেকে তীব্র বিরোধিতা আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতীয় সংকট ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এক জটিল সমীকরণের মুখোমুখি। একদিকে প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে, অন্যদিকে এনসিপি ও জামায়াতের মতো দলগুলো সংস্কার ও পদ্ধতিগত পরিবর্তনকে নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে দেখছে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা একটি দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও, দেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা এবং সেনাবাহিনীর আকস্মিক তৎপরতা এই পুরো প্রেক্ষাপটকে আরও অস্থির করে তুলেছে। সাংবাদিকসহ একাধিক হত্যাকাণ্ড এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারির ঘটনা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে নির্দেশ করে। এই ধরনের সহিংসতা একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির পথে প্রধান বাধা। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীর আকস্মিক তৎপরতা নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জনগণ সেনাবাহিনীকে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার রক্ষক হিসেবে দেখলেও, তাদের এই ভূমিকা যেন কোনোভাবেই দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণ না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সব পক্ষকে এক ছাতার নিচে এনে একটি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একদিকে যেমন দ্রুত রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে, তেমনি বিভিন্ন দলের দাবি-দাওয়াগুলোও এমনভাবে মোকাবেলা করতে হবে যাতে কোনো পক্ষই নিজেদের বঞ্চিত মনে না করে। এটি সম্ভব না হলে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার এই বিভাজন দূর করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার হয়।
সাংবাদিক ও লেখক।
আপনার মতামত লিখুন :