ad728

বাংলাদেশের রাজনীতির এক অনন্য অধ্যায়: বিএনপির ৪৭ বছরের পথচলা


FavIcon
নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত : ৩১ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ছবির ক্যাপশন: ad728

বাংলাদেশের রাজনীতির এক অনন্য অধ্যায়: বিএনপির ৪৭ বছরের পথচলা 
মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন
 
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এটি ছিল এমন একটি সময়, যখন সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গভীর শূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে জাতি খুঁজছিল একটি নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, যা বহুমুখী আদর্শের মানুষকে একত্রিত করতে পারে। সেই প্রেক্ষাপটে জন্ম নেওয়া বিএনপি আজ তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। প্রায় দেড় দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা সত্ত্বেও, দলটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছে। এটি কেবল একটি দলের জন্মদিন নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতিফলন।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গভীর শূন্যতা তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির বিভাজন, ডান, বাম ও মধ্যপন্থী মতাদর্শের ভিন্নতা, এবং একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থার অবসান এই বহুমুখী প্রেক্ষাপটে একটি নতুন জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল । এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তৎকালীন সামরিক শাসক ও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান তার শাসনকে বেসামরিক রূপ দিতে উদ্যোগী হন। তিনি ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল ১৯-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা ছিল তার রাষ্ট্রপরিচালনার মূল আদর্শ । এই কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে তিনি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে আহবায়ক করে 'জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল' (জাগদল) নামে একটি দল গঠন করেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল একটি পরীক্ষামূলক প্ল্যাটফর্ম, যা জিয়াউর রহমানের মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের পথ খুলে দিয়েছিল ।
১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পর, তিনি অনুভব করেন যে একটি বিস্তৃত ও জনভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দল ছাড়া তার ১৯-দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ফলস্বরূপ, ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর 'জাগদল' বিলুপ্ত করে ঢাকার রমনা ময়দানে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল' (বিএনপি) গঠনের ঘোষণা দেন ।
বিগ-টেন্ট কৌশল
বিএনপির জন্ম কেবল একটি রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি ছিল না, এটি ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি অনিবার্য পরিণতি। দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর 'মুক্তদ্বার নীতি' বা 'বিগ-টেন্ট' কৌশল। জিয়াউর রহমান সচেতনভাবে ডান, বাম, ও মধ্যপন্থী সকল মতাদর্শের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয়তাবাদী দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই কৌশলের মাধ্যমে তিনি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যা দেশের সকল অঞ্চলের এবং সকল পেশার মানুষকে একত্রিত করতে পারে । প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদে নির্বাচিত বিএনপি দলীয় সদস্যদের ১৬% পূর্বে ছিলেন মুসলিম লীগের, ১৫% ন্যাপের (ভাসানী), ৯% আওয়ামী লীগের এবং প্রায় ৪০% ছিলেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব । এই আদর্শগত বৈচিত্র্যই ছিল দলটির মূল শক্তি।
প্রতিষ্ঠার পরপরই জিয়াউর রহমান দলের অঙ্গসংগঠন গড়ে তোলার ওপর জোর দেন। ১৯৭৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল এবং ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল । এর মাধ্যমে তিনি দলটিকে কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন, যা ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো গঠনে সহায়ক হবে।
এই 'বিগ-টেন্ট' কৌশল তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপিকে একটি শক্তিশালী জনভিত্তি দিয়েছিল এবং মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে দলটি আওয়ামী লীগের সমান্তরালে দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় । 
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ 
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ', যা প্রচলিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে ভিন্ন একটি ধারণা। তিনি মনে করতেন, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতেই জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করা উচিত। তিনি বলেছিলেন, "আমরা কেবল বাঙালি নই; আমরা বাংলাদেশী" । এই দর্শনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন । তাঁর এই দর্শনটি ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সমন্বয়ে একটি নতুন জাতীয় পরিচয় রচনা করে। জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৮ (১) ধারা সংশোধন করে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি বাদ দিয়ে 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' অন্তর্ভুক্ত করেন, যা তার রাজনৈতিক দর্শনের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন । তার রাজনৈতিক দর্শনে ধর্মের সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্র শাসনের একটি ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস ছিল, যা তাকে একজন বাস্তববাদী রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিতি দেয় ।
রাষ্ট্রনায়ক জিয়ার আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি
রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল তার ১৯-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যা ছিল তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনার মূল ভিত্তি । এই কর্মসূচিগুলো কেবল রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না, বরং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা ছিল। এই কর্মসূচির আলোকে তিনি 'খাল কাটা' কর্মসূচি, স্বনির্ভর গ্রাম প্রকল্প এবং বৃক্ষরোপণ অভিযানের মতো গণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর এই কর্মমুখী চিন্তাধারা দেশের সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত করেছিল ।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯-দফা 
১. দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ২. গণতন্ত্র, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা, জাতীয়তাবাদ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। ৩ দেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। ৪. প্রশাসন, উন্নয়ন ও আইন-শৃঙ্খলার প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ৫. কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ ও জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা। ৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৭. কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৮. কোনো নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা। ৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। ১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ১১. সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং যুব সমাজকে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা। ১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান। ১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি এবং সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। ১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা। ১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা। ১৬. সকল বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব এবং মুসলিম দেশগুলির সাথে সম্পর্ক জোরদার করা। ১৭. প্রশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। ১৮. একটি দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ ও জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করা।
প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত কাঠামোকে বাদ দিয়ে বেসরকারি খাতের বিকাশে উৎসাহ দেওয়া হয়। তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন । প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে মেধার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, সামরিক বাহিনীর পুনর্বিন্যাস করা হয় এবং নারী পুলিশ নিয়োগের মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আনসার ও ভিডিপিকেও নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছিল । এই সংস্কারগুলো দেশের একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। 
আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া: গণতন্ত্রের সংগ্রামে এক নারী নেতৃত্ব
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও দলের চেয়ারম্যান বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ । এই পরিস্থিতিতে দলের অনেক নেতা সামরিক শাসকের সঙ্গে হাত মেলালেও, জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশ করে দলের হাল ধরেন। ১৯৮৩ সালে তিনি দলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। একজন গৃহবধূ থেকে দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করা তার রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্য অধ্যায়।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন ভূমিকা
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৮৩ সালে সাত দলীয় জোট গঠন করে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছরের আন্দোলনে নামে। এই দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি কোনো আপস করেননি, যা তাকে 'আপোষহীন নেত্রী' হিসেবে পরিচিতি দেয় । সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান এবং দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তার অনড় ভূমিকা তাকে ব্যাপক জনসমর্থন এনে দেয়। বিভিন্ন সময়ে তাকে সাতবার অন্তরীণ করা হলেও তিনি আন্দোলন থেকে পিছু হটেনি। অবশেষে, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মুখে এরশাদ ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয় এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনামল ও সংস্কার
খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বে (১৯৯১-১৯৯৬) দেশের শাসনব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। তার উদ্যোগেই ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংবিধানে ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়, যা রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশকে সংসদীয় গণতন্ত্রে রূপান্তরিত করে ।
তাঁর শাসনামলে অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্কারমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে । শিক্ষাক্ষেত্রে, তিনি প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক করেন, এবং মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করেন, যার ফলে নারীশিক্ষার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল ।
তারেক রহমান: রাজনৈতিক জীবনের সূচনা 
তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল তার বাবা-মায়ের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে। ১৯৯১,১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি তার মা বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, যা তাকে রাজনীতির ময়দানে পরিচিতি এনে দেয় । ২০০৯ সালে দলের পঞ্চম কাউন্সিলে তিনি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০১৮ সালে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ।
নতুন নেতৃত্বের কৌশল ও আদর্শিক বিবর্তন
দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং দমন-পীড়নের মুখেও তারেক রহমান আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে লন্ডন থেকে দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখেন এবং দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাদের ভূমিকা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেন । এই দূরবর্তী নেতৃত্বই গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দলকে বিভক্তি থেকে রক্ষা করেছে।
তার নেতৃত্বে দলে কিছু নতুন কৌশল ও আদর্শিক বিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিচ্ছেন । তার সাম্প্রতিক বক্তৃতায় 'বহুত্ববাদ' ও 'অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ' গড়ার বার্তা স্পষ্ট হয়েছে । তিনি সম্প্রতি একটি নতুন স্লোগান দিয়েছেন, 'দিল্লি নয়, পিণ্ডি নয়, নয় অন্যকোনো দেশ সবার আগে বাংলাদেশ' । এই স্লোগানটি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। 
ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা
তারেক রহমান কেবল দলের নেতৃত্বই দিচ্ছেন না, তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক রূপরেখা নিয়েও কাজ করছেন। তিনি 'জাতীয় সরকার' ও 'দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট' ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাবনা দিয়েছেন । তার '৩১ দফা' রূপরেখাটি জিয়াউর রহমানের ১৯-দফা কর্মসূচির ধারাবাহিকতা হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে । এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, ঐতিহ্যবাহী রাজনীতির বাইরে শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত করা ।এটি প্রমাণ করে যে, বিএনপি তার রাজনৈতিক কৌশলকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করতে সক্ষম।
চার দশকের রাজনৈতিক যাত্রায় বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অপরিহার্য শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন এবং আর্থ-সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে । 
তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি নিজেদের আদর্শ ও কৌশলকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। 'জাতীয় সরকার' এবং 'দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট'-এর মতো প্রস্তাবনাগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে দলের একটি ভিন্ন ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রচেষ্টা। এই প্রস্তাবনাগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে তা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। 

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সদস্য, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ।

আলোচিত শীর্ষ ১০ সংবাদ